বঙ্গবন্ধুর শয়ন কক্ষ

দোতালার বঙ্গবন্ধুর এই শয়ন কক্ষটিতে মুজিব দম্পতি তাদের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলকে নিয়ে ১৯৬৬ সালের প্রথম দিকে বসবাস শুরু করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালোরাতে নরপিচাশ ঘাতকেরা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের নবপরিণীতা স্ত্রী সুলতানা কামাল খুকু, মেজো ছেলে শেখ জামাল, শেখ জামালের স্ত্রী পারভীন জামাল রোজী, সাড়ে ১০ বছরের নিষ্পাপ শিশু কনিষ্ঠপুত্র শেখ রাসেল এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবকে। ঘাতকের দল শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি বাড়িটি লুটপাট করে প্রতিটি কক্ষ তছনছ করে রেখে যায়।
আজও প্রদর্শিত হচ্ছে কক্ষের পূর্বপাশের দেয়ালে কাঁচ দিয়ে ঢাকা রক্তের দাগ এবং মেঝেতে ঘাতকদের নিক্ষিপ্ত অসংখ্য গুলির চিহ্ন (কাঁচ দিয়ে ঢাকা)। ছাদের উপরে ঘাতকদের নিক্ষিপ্ত গুলির আঘাতে শেখ জামাল বা শেখ রাসেলের উৎক্ষিপ্ত শুকিয়ে যাওয়া মগজের সাথে মাথার কয়েকটা চুল কাঁচ দিয়ে ঢাকা। জাতির জনকের বিছানার পাশের টেবিল, ড্রেসিং টেবিল, ছোট ডেস্ক টেবিল, পড়ার টেবিল এবং টেবিলের উপর রাখা বেগম মুজিবের পানের বাটায় ছোপ ছোপ ও ছিটা ছিটা রক্তের দাগ আজও প্রদর্শিত রয়েছে। এই কক্ষে হত্যাকারীরা নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালিয়ে ছিল। ওই কক্ষে বঙ্গমাতার ঠিকানায় প্রেরিত মুখবন্ধ অবস্থায় আজও সংরক্ষিত রয়েছে একটি চিঠি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর প্রথমে ঘাতকেরা ও তারপর সামরিক বাহিনী বাড়িটি দখল করে রাখে। দীর্ঘ ছয় বছর পর ১৯৮১ সালের ১০ জুন জাতির জনকের দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বাড়িটি যখন বুঝে পান তখন প্রতিটি কক্ষ ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন, মাকড়সার জাল, ধুলোবালি, পোকা-মাকড় এবং দীর্ঘদিন অযত্নের ফলে বাড়ির সমস্ত জিনিসপত্র নষ্ট হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর শয়ন কক্ষের পাশে ড্রেসিং রুমের আলমারিতে এবং অন্যান্য রুমের জামাকাপড় লণ্ডভণ্ড পোকায় খাওয়া অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। বাড়ির সর্বত্রই হত্যাকারীদের লুটপাটের চিহ্ন পাওয়া যায়।
শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বাড়ি ফিরে পাওয়ায় তারা নিজ হাতে বাড়ির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন। সেই স্মৃতিটুকু শেখ হাসিনার বয়ন থেকে নেওয়া যেতে পারেঃ
"বাড়িটাকে একদিন মিউজিয়াম করব তার আগে পরিস্কার করা দরকার। মনকে শক্ত করা অত্যন্ত কঠিন। জিনিষপত্র গুলিতে হাত দেয়া কী যে বেদনাদায়ক তা লিখে বোঝানো যাবেনা। শুধু যারা এভাবে সব হারিয়েছেন তারাই হয় তো বুঝতে পারবেন। আমার মা অত্যন্ত পরিপাটি গোছানো স্বভাবের ছিলোন। প্রতিটি জিনিস জায়গামত খুঁজলে পাওয়া যায়। শীতের কাপড় এক আলমারিতে গোছানো,গরমের কাপড় অন্য আলমারিতে। তেমনি কাপড় আলনায়,স্যান্ডেল,জুতা পর্যন্ত সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতেন। ........
আমার মায়ের হাতের সেই সুন্দর গোছানো সব কিছু আজ দানব খুনীদের হাতে লন্ডভন্ড হয়ে আছে। মনকে মানিয়ে এক সময় বালতি ভর্তি পানি,সাবান,কাপড়,ঝাড়ু নিয়ে সব ঘর পরিস্কার করতে শুরু করলাম । এত ময়লা যে,একটা ঘর পরিস্কার করতে পাঁচ-ছয় ঘন্টা কাজ করেও পাঁচ-ছয়দিন লেগেছে। নিজের হাতে সব পরিস্কার করে আমার মা যেভাবে যে জিনিস রাখতেন,ঠিক সেখানে রাখতে চেষ্টা করেছি। দু"হাতে ময়লা সাফ করেছি আর চোখের পানি ফেলেছি। শুধু মনে হয়েছে এই জন্যই কি বেঁচেছিলাম। কী দুর্ভাগ্য আমার সবই চলে গেল। আমি হতভাগিনী শুধু চোখের জলে ভাসছি আর বেদনা যন্ত্রণা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে কষ্টে দম বন্ধ হয়ে গেছে। কাজ বন্ধ রেখে অনেকক্ষন আকুল হয়ে কেঁদে নিতাম,অবার এক সময় মনকে শক্ত করতাম ...........ঘরে যত ধুলা ময়লা ছিল কিছুই ফেলিনি বড় বড় পলিথিনের ব্যাগে ভরে রেখেছি। কেন যেন ফেলতে পারলাম না। মনে হয় যেন সব ছিল, সবই ছিল এই মাত্র বাইরে গেছে আবার আসবে , অবার আসবে ..............."