বিজয়ের মাসে ঘুরে আসুন বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর

বিজয়ের মাসে ঘুরে আসুন বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর

২০১৬-১২-০২

ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাঙালির ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এছাড়াও আছে বাঙালির স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস, আছে হারানোর বেদনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে একদল বিশ্বাসঘাতক খুনিদের হাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের নিজ বাড়িতে সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুুর রহমান।

পরবর্তীতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়িটিকে ঘোষণা করা হয় ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে। বিজয়ের মাসে ঘুরে আসতে পারেন এই স্মৃতিময় স্থান থেকে। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ঘুরে এসে জানাচ্ছেন মাহবুবর রহমান সুমন।

ইতিহাস
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের এই বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। ১৯৬২ সালের আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ৭০ সালের নির্বাচন ও ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনসহ যুদ্ধের প্রথম উত্তাল দিনগুলোতে তিনি এ বাড়িতে বসেই সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা ও রাজনৈতিক বিভিন্ন মিটিং তিনি এখানেই করতেন। এই বাড়ি থেকেই পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে অসংখ্যবার গ্রেফতার করে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি এখান থেকেই তার রাষ্ট্রীয় কর্ম পরিচালনা করতেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে সপরিবারে এই বাড়িতেই প্রাণ দিতে হয়। সেদিন শুধু আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর বোন শেখ রেহানা বিদেশে থাকার কারণে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন।

তারপর ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কাছে বাড়িটি হস্তান্তর করা হয়। শেখ হাসিনা ১৯৯৩ সালে বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তরের জন্য বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করেন। পরে ট্রাস্ট বাড়িটিকে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তরিত করে। ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট জাদুঘরটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।

জাদুঘরে যা আছে
ছায়া সুনিবিড়, সবুজ গাছে ঘেরা সাদা রঙের তিনতলা মূল বাড়ি এবং এর পাশের সম্প্রসারিত আরেকটি ভবন নিয়েই জাদুঘর। বাড়িটির সামনে ধানমন্ডি লেক। বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের মূল বাড়ির প্রথম তলার শুরুতেই রয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল এক ছবি। প্রথম তলায় রয়েছে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টে নিহত সবার ছবি এবং কিছু আসবাবপত্র। এই ঘরটি আগে ছিল ড্রইং রুম। এখানে বসে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু দেশ-বিদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে বৈঠক করতেন। এই ঘরের পাশের ঘরটি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের পড়ার ঘর। এখানে তিনি লেখালেখির কাজও করতেন। ১৯৭১ সালে এই ঘর থেকেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠিয়েছিলেন। এরপর দোতালায় ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সময় এখনো চোখে পড়বে সেই রাতের তাণ্ডবলীলার নিদর্শন, দেয়ালের গায়ে গুলির চিহ্ন। সেখানে শিল্পীর তুলিতে আঁকা বঙ্গবন্ধুর গুলিবিদ্ধ অবস্থার একটি প্রতিকৃতিও রয়েছে।

দোতলায় বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষ। ১৫ আগস্ট ভোরে বেগম মুজিব, জামাল, কামাল, রাসেল ও বঙ্গবন্ধুর দুই পুত্রবধূর রক্তাক্ত মৃতদেহ এখানে পড়েছিল। আর এ ঘরের সামনে করিডোর থেকে নিচে যাওয়ার জন্য যে সিঁড়ি সেখানেই ঘাতকদের গুলিতে মারা যান বঙ্গবন্ধু। এখনো গুলির স্পষ্ট চিহ্ন সেখানে রয়ে গেছে। সিঁড়িটি এখন দড়ি দিয়ে বন্ধ করে দেয়া। বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষে তার বিছানার পাশেই ছোট টেবিলে সাজানো আছে তার হাতে থাকা পাইপটি। তামাকের কৌটা। এ কক্ষে অন্যান্য আসবাবের মধ্যে আরও আছে টেলিফোন সেট ও রেডিও। কিছু রক্তমাখা পোশাক। সামনের খাবার ঘরের পাশেই আছে শিশু রাসেলের ব্যবহার করা বাইসাইকেল। উল্টো দিকে শেখ জামালের কক্ষে দেখা যায় তার সামরিক পোশাক। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানার কক্ষও একই তলায়। বাড়ির তৃতীয় তলায় শেখ কামালের কক্ষ। এ কক্ষে তার বিভিন্ন সংগীতযন্ত্র সাজিয়ে রাখা আছে। বাড়ির রান্নাঘরের হাঁড়িগুলো বেশ পরিপাটি করে সাজানো।

এ ভবনের মোট নয়টি কক্ষে বিভিন্ন সামগ্রীর মধ্যে আরও আছে বঙ্গবন্ধুর পুত্রবধূ সুলতানা কামালের বৌ-ভাতের সবুজ বেনারসি শাড়ি, রোজী জামালের লাল ঢাকাই জামদানি, বিয়ের জুতা, ভাঙা কাচের চুড়ি, চুলের কাঁটা, শিশুপুত্র রাসেলের রক্তমাখা জামা, বঙ্গবন্ধুর রক্তমাখা সাদা পাঞ্জাবি, তোয়ালে, লুঙ্গি, ডায়েরি ইত্যাদি।

এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যবহার্য আসবাবের মধ্যে আরও আছে খাবার টেবিল, টেবিলের ওপর থালা, বাটি। আছে রেকসিনের সোফা। খাওয়ার পর এ সোফায় বসে বিশ্রাম নিতেন বঙ্গবন্ধু। এই ঘরের দেয়ালেও রয়েছে গুলির চিহ্ন। এখানে পিয়ানো, সেতার ইত্যাদি আগের মতো করেই সাজানো আছে। ১৯৭৫ সালের পনেরো আগস্টের হত্যাযজ্ঞ, লুটপাটের পর যা কিছু ছিল সব দিয়ে আগের মতো করেই সাজানোর চেষ্টা করা হয়েছে পুরো বাড়িকেই।

বাড়ির পেছনেই জাদুঘরের সম্প্রসারিত নতুন ভবন। এর নাম ‘শেখ লুৎফর রহমান ও শেখ সায়েরা খাতুন গ্যালারি’। বঙ্গবন্ধুর বাবা-মায়ের নামে রাখা হয়েছে নতুন ভবনের নাম। ২০১১ সালের ২০ আগস্ট এ অংশটি আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেয়া হয়। ছয় তলা ভবনের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র রয়েছে। পঞ্চম তলায় পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র। জাদুঘর ভবন থেকে বের হয়ে এসে রাস্তার উল্টো দিকে লেকের পাশে  রয়েছে বঙ্গবন্ধুর একটি প্রতিকৃতি।

যেভাবে যাবেন
ঢাকার প্রাণকেন্দ্র ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কেই অবস্থিত বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর। জাদুঘরের পাশেই রয়েছে ধানমন্ডি লেক। ঢাকার যেকোনো স্থান থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি বা বাসে চড়ে আসতে পারবেন এখানে।

প্রবেশ মূল্য
টিকিটের মূল্য মাত্র ৫ টাকা। তবে ৩ বছরের নিচের বাচ্চাদের জন্য কোনো টিকিট কাটতে হয় না। আর যাদের বয়স ১২ বছরের কম, তাদের জন্য রয়েছে শুক্রবারে বিনামূল্যে জাদুঘর ঘুরে দেখার সুযোগ।

সাপ্তাহিক ছুটির দিন
এখানে সাপ্তাহিক ছুটির দিন বুধবার। এই দিন ছাড়া যেকোনো দিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৫টা পর্যন্ত যেকেউ ঘুরে দেখতে পারবেন।